Saturday, November 5, 2011

শরিকি চাপেও লক্ষ্যে অটল হুঁশিয়ারি দিলেও তিনিই ‘ত্রাতা’, বোঝালেন মমতা নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা ও নয়াদিল্লি

শরিকি চাপেও লক্ষ্যে অটল
হুঁশিয়ারি দিলেও তিনিই 'ত্রাতা', বোঝালেন মমতা
পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রের জোট সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার 'চরম হুঁশিয়ারি' দিয়ে রাখল শরিক দল তৃণমূল। দলীয় সাংসদরা 'সর্বসম্মতিক্রমে' সরকার ত্যাগের সিদ্ধান্ত নিলেও দলনেত্রী তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের আপাতত 'নিবৃত্ত' করেছেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ দেশে ফিরলে তাঁর সঙ্গে আলোচনার পরেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বৃহস্পতিবার রাতে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পরেই প্রবল ক্রুদ্ধ হন মমতা। রাতেই তিনি নির্দেশ দেন শুক্রবার দুপুরে সমস্ত সাংসদকে নিয়ে সংসদীয় দলের জরুরি বৈঠক ডাকার। ঠিক হয়, কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে। তবে তৃণমূলের মতো 'নেত্রী-কেন্দ্রিক' দলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার যে মমতার উপরেই ছেড়ে দেওয়া হবে, তা প্রত্যাশিতই ছিল। বাস্তবেও তার অন্যথা হয়নি। সংসদীয় দলের বৈঠকে 'সর্বসম্মতিক্রমে' সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে সাংসদরা যান মহাকরণে। সেখানে মমতা তাঁদের 'অভিনন্দন' জানান। কিন্তু বলেন, এখনই ওই সিদ্ধান্ত না-নিতে। প্রকাশ্যেও মমতা বলেন, "ভোট লড়েছি এক সঙ্গে। পাঁচ বছর সরকার যাতে থাকে, তা দেখা দরকার। আমরা সমর্থন তুললে সরকার পড়ে যাবে।"
আপাতত ঠিক হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফিরলে তাঁর সঙ্গে তৃণমূলের মন্ত্রী-সাংসদরা দেখা করতে যাবেন এবং তাঁদের 'প্রতিবাদে'র কথা নথিবদ্ধ করবেন।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক সেরে বেরোচ্ছেন তৃণমূলের
সাংসদরা। শুক্রবার মহাকরণে সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
তৃণমূল শিবিরের মতে, দক্ষিণ কলকাতা লোকসভা কেন্দ্রে উপনির্বাচনের আগে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির মতো একটি 'স্পর্শকাতর' বিষয়ে এ দিন মমতা 'মাস্টারস্ট্রোক' দিয়েছেন। এক দিকে মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে সাংসদদের দিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের উপর থেকে সমর্থন তোলার 'হুঁশিয়ারি' দিয়ে আমজনতার কাছে 'বার্তা' দিতে চেয়েছেন যে, তাঁরা ওই সিদ্ধান্তের 'পাশে নেই'। তেমনই সাংসদদের 'চরম সিদ্ধান্ত' নেওয়া থেকে আপাতত বিরত থাকার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তথা কংগ্রেসের উদ্দেশেও 'সঙ্কেত' পাঠিয়েছেন যে, তাঁর নির্দেশেই এ যাত্রা 'টিকে' গেল কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, তৃণমূল সমর্থন তুলে নিলে সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবে। সেই 'সঙ্কেতের' ইঙ্গিত এ দিন মমতার বক্তব্যেও মিলেছে, "এখানে (রাজ্যে) আমরা একার ক্ষমতায় সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কেন্দ্রে কংগ্রেস তা নয়। আমাদের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা আছে।"
তৃণমূলের একাংশ মনে করছে, এই বক্তব্যের মাধ্যমে মমতা কেন্দ্রকে আরও একটি 'বার্তা' পাঠিয়েছেন তাঁরা 'কঠিন' পরিস্থিতিতেও ইউপিএ ছেড়ে আসছেন না। পরিবর্তে কেন্দ্রীয় সরকারও 'রাজ্যকে দেখুক'। যাকে দলের এই অংশ প্রকারান্তরে কেন্দ্রীয় সাহায্যের জন্য চাপ বাড়ানো বলে ব্যাখ্যা করতে চায়। মমতা নিজে অবশ্য বলেছেন, "আমরা কাউকে ব্ল্যাকমেল বা কারও সঙ্গে দর-কষাকষি করছি না। কোনও হঠকারী সিদ্ধান্তও নিচ্ছি না। আমাদের কিছু চাইও না!" বস্তুত, মহাকরণে সাংসদদের সঙ্গে আলোচনার পর মমতা জোড়হাতে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্দেশে বলেন, "যে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে (তৃণমূলের সংসদীয় দলকে), তার জন্য দয়া করে ক্ষমা করবেন। আবার হাতজোড় করে অনুরোধ করছি মানুষের কথা ভাবুন।"
মমতার এই 'হুঁশিয়ারিতে' কংগ্রেস নেতৃত্ব অবশ্য 'বিরক্ত'। দলের শীর্ষ সূত্রে এ দিন তেমনই ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। দলের এক প্রথম সারির নেতার কথায়, "উনি এই ধরনের কাণ্ড না-ঘটালেই পারতেন।"
বস্তুত, কংগ্রেসের একাংশ মনে করছে, এই মুহূর্তে মমতারও কংগ্রেসকে 'দরকার'। তৃণমূল ইউপিএ ছেড়ে বেরিয়ে এলে এক দিকে যেমন পশ্চিমবঙ্গের জন্য নির্দিষ্ট রেল প্রকল্পগুলি আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে, তেমনই সিপিএমের ছেড়ে-যাওয়া দেউলিয়া অর্থভাণ্ডার নিয়ে রাজ্য চালাতে সঙ্কটাপন্ন মুখ্যমন্ত্রী মমতার কেন্দ্রীয় সাহায্যের দরজাও বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে কংগ্রেসের দাবি, কেন্দ্রে সরকার টিকিয়ে রাখার তাগিদ যেমন তাঁদের রয়েছে, তেমনই রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীরও।
মমতার এ দিনের আচরণকে 'দ্বিচারিতা' বলে অভিহিত করেছে সিপিএম। দলের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট এবং রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান তথা সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু বলেছেন, "গত বছরের জুন মাসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার যে বৈঠকে পেট্রোলের দাম নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত করা হয়েছিল, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যক্তিগত ভাবে উপস্থিত ছিলেন!" পলিটব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাটের কথায়, "উনি মূল নীতিটাকে সমর্থন করেছিলেন। সেই নীতির ফলে বারবার দাম বাড়ছে। উনি তখন আপত্তি তুলছেন। এটাই দ্বিচারিতা।" সম্প্রতি কলকাতায় এসে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী মমতার সমালোচনা করলেও এ দিন অবশ্য কৌশলগত কারণেই কার্যত তাঁর প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, "বিভিন্ন ক্ষেত্রে মমতার সঙ্গে আমার মত মেলে না বটে, কিন্তু তাঁর দৃঢ়তাকে আমি সম্মান করি।" মমতার মূল আপত্তি অবশ্য যে ভাবে বারবার তাঁদের 'অন্ধকারে' রেখে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে। মমতার কথায়, "গত ১২ মাসের মধ্যে ১১ বার কখনও পেট্রোল-ডিজেল, কখনও কেরোসিন বা রান্নার গ্যাসের দাম একতরফা ভাবে ও আলোচনা না-করে বাড়ানো হয়েছে। জনগণের অসুবিধা করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার পক্ষে নয় তৃণমূল।"
দলের নেতাদের মতে, নেত্রীর এই বিবৃতির মধ্যে দিয়ে স্পষ্ট যে, এ ভাবে জনগণের উপর 'বোঝা' চাপায় তিনি 'উদ্বিগ্ন'। যা অন্য দিক দিয়ে তাঁর তরফে সিপিএমের মোকাবিলাও বটে। কেন্দ্রের 'জনস্বার্থ বিরোধী' সিদ্ধান্তের দায়ভার যাতে শরিক হিসেবে তৃণমূলের উপর না-বর্তায়, সে দিকে লক্ষ্য রেখেই মমতা বলেন, "গত আড়াই বছরে অনেক মেনেছি। আর পারছি না! কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় একমাত্র দীনেশ'দা (রেলমন্ত্রী) রয়েছেন। কিন্তু ওঁর কথা তো শুনতেই চায় না কেউ! শরিক দলের সঙ্গে কোনও সমন্বয় নেই। মনিটরিং ব্যবস্থা নেই। তাই চরম সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। হাতজোড় করে বলছি, বিরত থাকুন (জনস্বার্থবিরোধী সিদ্ধান্ত থেকে)।"
দাম না বাড়িয়ে তাঁরা কি পুরনো দামে ফিরে যাওয়ার (রোল-ব্যাক) পক্ষপাতী? মমতা সাফ বলেন, "রোল-ব্যাক করে কী হবে? আজ কমলে আবার বেড়ে যাবে! পুরো ব্যাপার যা হচ্ছে, সেই পদ্ধতিটাই মানতে পারছি না!"
বৃহস্পতিবার রাতেই মমতা কথা বলেছিলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়রাম রমেশের সঙ্গে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায়। এ দিন মহাকরণে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আনন্দ শর্মার সঙ্গে এ বিষয়ে একদফা কথা হয় মমতার। যা তৃণমূলের তরফে 'ইতিবাচক' বলেই দাবি করা হয়েছে। বৈঠকের পরে আনন্দ শর্মা বলেন, "মমতা ওঁর উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। আমরা একসঙ্গে সরকারে রয়েছি। দেশের বৃহত্তর স্বার্থ দেখার দায়িত্ব আমাদের দু'জনেরই। তবে মমতার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রী এবং সনিয়া গাধীকে জানাব।" মমতা বলেন, "মুকুল কাল (বৃহস্পতিবার) রাতে প্রণব'দাকে ফোন করেছিল। প্রথমে তাঁকে পায়নি। হয়তো প্রণব'দা ব্যস্ত ছিলেন। পরে তিনি নিজেই মুকুলকে ফোন করে জানান, দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না!" এর পরেই সংসদীয় দলের 'জরুরি বৈঠক' ডাকা হয়।
তপসিয়ায় তৃণমূল ভবনে ওই বৈঠকে লোকসভা-রাজ্যসভা মিলিয়ে দলের ২৫ জন সদস্যের মধ্যে ২১ জন উপস্থিত ছিলেন। দিল্লিতে আটকে পড়ায় আসতে পারেননি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী শিশির অধিকারী। হজ করতে বাইরে থাকায় ছিলেন না কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সুলতান আহমেদও। সাংসদ গোবিন্দ নস্করও অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি।
বৈঠকে প্রায় সকলেই পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তের কড়া বিরোধিতা করে সরকারের উপর থেকে সমর্থন তোলার অভিমত প্রকাশ করেন। ওই বিষয়ে সবচেয়ে জোরালো সওয়াল করেন সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়। মন্ত্রী সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রস্তাব দেন, মন্ত্রীরা তাঁদের ইস্তফাপত্র লিখে মমতার কাছে জমা দিন। মমতা দরকার মতো তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠিয়ে দেবেন। তবে মন্ত্রীদের মধ্যে সৌগত রায়ের সুর খানিকটা 'নরম' ছিল বলেই সংসদীয় দল সূত্রের খবর। তিনি বলেছিলেন, বিষয়টি কেন্দ্রীয় সরকারের নয়, তেল সংস্থাগুলির এক্তিয়ার-ভুক্ত। তবে দীনেশ ত্রিবেদী, সুদীপবাবু এবং সাংসদদের মধ্যে শুভেন্দু অধিকারী, কাকলি ঘোষ দস্তিদার, সোমেন মিত্র, কল্যাণবাবুরা সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসার পক্ষে জোরালো সওয়াল করেন। দীনেশ অভিযোগ করেন, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে মন্ত্রিসভায় কংগ্রেস অনেক প্রস্তাবই পাশ করিয়ে নেয়। পেট্রোপণ্যের দাম বৃদ্ধির মতো সিদ্ধান্ত 'একতরফা ভাবে' পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। তিনিও সরকার ছাড়ার পক্ষেই মত দেন। এমনকী, তৃণমূল ভবন থেকে মহাকরণে যাওয়ার সময় দীনেশ সরকারি গাড়িও ব্যবহার করেননি! পরে অবশ্য পরিস্থিতির বদল হওয়ায় তিনি সরকারি গাড়িতে ফিরে যান।
রাজ্য-রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন, আপাতত অবস্থা 'সামাল' দিলেও দীর্ঘমেয়াদি ভিত্তিতে মমতা খানিকটা 'বিপন্ন' হতে পারেন। মমতা বরাবরই 'জনমুখী' রাজনীতি করে এসেছেন। কিন্তু 'সফল' প্রশাসক হতে গেলে তাঁকে কর বসিয়ে রাজস্ব আদায়ের মতো 'কঠোর' সিদ্ধান্ত নিতে হবে। মমতার এ দিনের পদক্ষেপ তাঁকে অদূর ভবিষ্যতে কোথায় নিয়ে ফেলে, সেটা অবশ্যই দেখার। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ, যা দিনের শেষে বলেছেন তৃণমূলের এক সাংসদ, "কেন্দ্রীয় পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী জয়পাল রেড্ডি তো বলেছেন, এর পর ২১ নভেম্বর বৈঠক করে রান্নার গ্যাস আর ডিজেলের দামও নিয়ন্ত্রণ-মুক্ত করে দেওয়া হবে! প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এ দিন সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তখন সরকার থেকে বেরিয়ে আসা ছাড়া উপায় থাকবে তো?"

http://www.anandabazar.com/5raj1.html

No comments: